প্যারেন্টিং, পার্টনারশীপ ও জীবনের জন্য প্রযুক্তি। এই তিনটা বই আগামী বছর পাবলিশের জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। বিশেষ করে ৬৪ জেলা ট্রাভেলের সময়টায় এই বই তিনটার পেছনে প্রচুর সময় দেয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু এক প্রকাশকের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানতে পারলাম কিছুদিন আগে যে বই পাবলিশ করতে ৪০ হাজার টাকা খরচ হতো সেটা এখন লাখ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে।
আমার এই তিনটা বইয়ের কোনটাই ৫০০ পৃষ্ঠার নিচে না। এর ভেতরে প্যারেন্টিং বইটার হাজার পৃষ্ঠা ছাড়াতে পারে বলে মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তো মনে হয় না ১৫০০ টাকার নিচে মূল্য নির্ধারণ করা যাবে। ১৫০০ টাকা দিয়ে কতজন এই বই কিনতে পারবে?
বইটার কনটেন্ট থিংকার ক্লাউডে থাকবে, কিন্তু কাগজের বই পাবলিশের পর সেটা অনলাইনে এভেইলেবল করবো। যারা হার্ড কপি কিনবে, তারা অনলাইন কপি ফ্রি পাবে। প্রকাশকদের দিকটা মাথায় রেখেই এটা করতে হচ্ছে। এখন এই মূল্যস্ফিতিতে কী করা যায়!
পার্টনারশীপ - ৯
বাবা-মা'য়ের পরে আমাদের সবচাইতে আপন হওয়ার কথা ভাই/বোনরা। এই ভাই বোনদের সাথে যদি কারো সম্পর্ক ভালো না থাকে, সেটা খুবই দুঃখজনক একটা ব্যাপার।
ভাই-বোনদের সাথেও যে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, এটা প্রথমে যখন জেনেছি তখন এই প্রশ্নগুলো জেগেছিলো-
কারো আপন ভাইবোন কিভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে?
কেন কেউ নিজের ভাইবোনদের হিংসা করবে?
ইগো কেন ও কিভাবে কাজ করে এখানে?
স্কুলে থাকতে যখন গল্প-উপন্যাসে এধরনের বিষয়ের সন্ধান পাই, তখন ভেবেছি এগুলো বাস্তবে ঘটে না হয়তো। কলেজে উঠার কিছুদিন আগে প্রথম এধরনের ঘটনা নোটিশ করি আমাদের পরিচিত এক পরিবারে। তখন থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছি। এর সব উত্তর যে খুঁজে পেয়েছি, এরকম না। তবে এটুকু বলতে পারি যে- এর সাথে প্যারেন্টিং জড়িত। এই বিষয়ে প্যারেন্টিং সিরিজ/বইয়ে আরো বিশদ আলাপ থাকবে। আপাতত এর থেকে বের হয়ে আসার কিছু উপায় বের করার চেষ্টা করি।
এধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে যেসব মাইন্ডসেট কাজ করে, তার পেছনে কাজ করে কিছু ক্যালকুলেশন। সম্পর্ক যে ক্যালকুলেশনের ব্যাপার না, এটা বুঝার মত ম্যাচুরিটি না থাকার ফলে লোকজন এই হিসাব করে। এছাড়াও আছে দুনিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা।
এই ম্যাচুরিটি আর দুনিয়ার জ্ঞান তো কারো ভেতরে সরাসরি ইনজেক্ট করার উপায় নেই, তবে কিছু বিষয় নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
আপনার বয়স যদি এখন ২৫ হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ভাইবোনদের সাথে কাটানো সময়ের পরিমান কমপক্ষে ২০ বছর। ৭৩০৫ দিন হয় ২০ বছরে। এর মাঝে অন্তত ৭ হাজার দিন আপনি অবশ্যই ভাই-বোনদের সাথে একসাথে থেকেছেন ধরে নেয়া যায়। এই ৭ হাজার দিনে হয়তো আপনার মন খারাপ হওয়ার মত ও রেগে যাওয়ার মত অনেকগুলো কারণ ঘটিয়েছে আপনার ভাই বা বোন। কিন্তু, কতটি?
এক্ষেত্রে ভেবে দেখেন, আপনার প্রিয় কোন বন্ধু বা ব্যক্তির সাথে আপনি কতদিন কাটিয়েছেন?
আমি বলবো, যাদেরকে আপনি নিজের ভাই-বোনের চাইতেও বেশী পছন্দ করেন, তাদের সাথে মাত্র ৭০ দিন থেকে আসেন। ভার্সিটি হল বা মেসে যারা থেকেছেন, কিংবা দেশের বাইরে আছেন, তারা জানেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। এই ৭০ দিন থাকার পর আপনিও জানতে পারবেন। কমপক্ষে এক মাস থেকে আসুন। বুঝতে পারবেন, আরেকজন মানুশের সাথে একসাথে থাকলে কত কী হতে পারে।
এই একমাস থাকা না গেলেও আপনি জানবেন একদিন। কিন্তু অনেক পরে। হয়তো দূরে চলে যাওয়ার পর অথবা বিয়ের পর। কিন্তু, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? অপেক্ষা না করে একটু ভেবে দেখতে পারেন।
একই পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে বড় হওয়া আপনার ভাইবোনদের সাথে মননগত যে মিল আপনার আছে, সম্পূর্ন ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা আরেকজনের সাথে সেই মিল না থাকাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে, একই ঘরের ভাই-বোনদের সাথেই যদি আপনি মিলে-মিশে না থাকতে পারেন তাহলে দূরের কারো সাথে থাকবেন কিভাবে?
ভাবতে থাকেন।
পার্টনারশীপ - ৮
মানবজীবনের আরেকটা বড় ট্রাজেডি হচ্ছে কাছের/আপন মানুশ কম থাকা বা একেবারেই না থাকা। তিন ভাবে কেউ আপন হতে পারে—
১) ফ্যামিলি থেকে
২) বিয়ের মাধ্যমে
৩) বন্ধুত্ব থেকে
এর মাঝে তিন নাম্বারটা অনিশ্চিত। বন্ধুদের মাঝ থেকে কাছের মানুশ পাওয়াটা আপনার নিজের আচরণ ও ভাগ্যের উপরে নির্ভর করে। সাথে, যে সোসাইটিতে আপনি বাস করছেন সেখানকার কালচারের উপরেও নির্ভর করে অনেকটা। ফলে বন্ধুরা যে আপন হবে, এর কোন নিশ্চয়তা নেই।
বিয়ে থেকে কাছের মানুশ পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান সময়ে এটা ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি আপনার বাচ্চারাও আপনার কাছের মানুশ না হওয়ার সম্ভবনা আছে। এর সাথে আপনার নিজের আচরণ ও যে ফ্যামিলিতে বিয়ে করেছেন তাদের কালচার নির্ভরশীল। সেই সাথে আপনার সোসাইটি তো আছেই।
বাকী রইলো নিজের ফ্যামিলি। প্রথমে ফ্যামিলি অংশটা নিয়ে বলি।
নিজের ফ্যামিলি বলতে প্রথমে আসে বাবা-মা ও ভাই-বোনরা। এরপর মামা-মামী, চাচা-চাচী ও কাজিনরা। এরপর আরো দূরের যারা আছে। আপনার ম্যারেজ যদি ভালো হয়, তাহলে শশুরবাড়ির দিক থেকেও পার্টনারের ভাই-বোন, কাজিন ও আত্মীয়-স্বজনরা যোগ হবে।
তাহলে একজন মানুশের কতগুলো কাছের মানুশ থাকার কথা? একদম মিনিমাম একটা হিসাব করি চলেন—
১) আপনারা যদি মাত্র দুই ভাইবোনও হয়ে থাকেন, তাহলে ভাই/বোন+বাবা+মা = ৩ জন
২) আপনার যদি নূন্যতম একজন ফুফি, চাচা, মামা ও খালা থাকে, তাহলে = ৪ + ৪ = ৮ জন (তাদের লাইফ পার্টনার সহ)
৩) সেই ফুফি, চাচা, মামা, খালাদের যদি মিনিমাম দুজন করেও বাচ্চা থাকে, তাহলে = ৮ জন ফার্স্ট কাজিন। সেকেন্ড, থার্ড কাজিন ও দূরের আত্মীয়দের ধরলাম না আপাতত।
মোট (৩ + ৮ + ৮) = ১৯ জন (কমপক্ষে)। তাদের সবার যদি একটা করে বাচ্চা থাকে, তাও ১১ জন হয়। এর নিচে কিন্তু না। বাস্তবতা হচ্ছে এই সংখ্যাটা ২০ থেকে ৩০ এর উপরে থাকে সাধারণত। গড়ে আমরা ১৫জন ধরে নেই আপাতত।
৪) ভালো ম্যারেজ হলে উপরের সংখ্যাটা দ্বিগুনের বেশী হবে (লাইফ পার্টনারসহ)। লাইফ পার্টনার + শশুর-শাশুড়ি মিলে সংখ্যাটা কমপক্ষে ৩৩ হয়।
৫) আপনি যদি ভালো প্যারেন্ট হন আর লাইফ পার্টনার যদি ভালো হয়, তাহলে আপনার বাচ্চারাও কাছের মানুশ হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে— কমপক্ষে ১৫ থেকে ৪০ জনের একটা ফ্যামলি আপনার থাকার কথা, যাদের কাছের বা আপন মানুশ হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়।
কিন্তু, কতজন কাছের মানুশ আছে আপনার? যদি না থাকে, কেন নাই? থাকলে কী হতো বা কেন থাকা উচিত? আর সেটা আপনার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারতো? এইসব নিয়ে আরো আলাপ হবে পরের পর্বে।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে— আপনি নিজে কেমন; তারচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার পার্টনারের চোখে কেমন। আপনি নিজে যা-ই হয়ে থাকেন না কেন, পার্টনার যদি আপনাকে খারাপ মনে করে, সেই সম্পর্ক টক্সিক হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে যত দ্রুত আপনি সরে আসতে পারবেন, তত ভালো।
আবার আপনার অনেক দোষ ত্রুটি থাকার পরেও পার্টনার যদি আপনাকে ভালো মনে করে এবং দোষগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে বিশ্বাস করে, তখন আপনার জন্য বদলে যাওয়াটাও সহজ। এরকম হলে যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে ঠিক করে ফেলাই ভালো। কারণ, এধরনের মানুশের সংখ্যা খুব কম যারা আপনাকে এই সুযোগটা দিবে।
বড়-ছোট নির্ধারণ করতে গেলেই প্রতিযোগীতা চলে আসে। পার্টনার তখন কম্পিটিটরে পরিনত হয়। কম্পিটিটররা কখনো একে অপরের আপন হয় না।
পার্টনারশীপ - ৬
পৃথিবীর সবচাইতে দামী জিনিষ হচ্ছে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব। কিছু কাছের মানুশ পাওয়া। কাছের মানুশ পাওয়াটা এখন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ম্যাটেরিয়ালিজমের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রসারের ফলে এটা ঘটেছে। যার অনেক আছে, তাকেও অভাবী বানিয়ে দেয় এই জিনিষ। যার কারণে একজন আরেকজনের সাথে সম্পর্ক করে কিছু না কিছু পাওয়ার জন্য। কোন একটা ম্যাটেরিয়ালিস্টিক গেইনের জন্য। ফলে, যেখানে লাভ নাই সেখানে সম্পর্কও থাকে না। অথচ, সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব জিনিষটা এরকম জাগতিক চাওয়া পাওয়ার জিনিষ না।
একটা পর্যায়ে এসে অবশ্য অনেকে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। ম্যাটেরিয়ালিজমের প্রচার ও প্রসারে জীবন উৎসর্গ করে দেয়া লোকজনকেও এই রিয়েলাইজেশন স্বীকার করে যেতে দেখা গিয়েছে। বিদেশী অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির এধরনের স্বীকারোক্তি আছে। বাংলাদেশেও কিছু উদাহরণ আছে। এদেশের জনপ্রিয় নায়িকা ও সাবেক সংসদ সদস্য কবরী একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন- 'জীবনে একটা ভালো বন্ধু পেলাম না।'
এই ভালো বন্ধু তৈরি করতে হয় ইয়ং বয়স থেকেই। একটা বয়স পার হয়ে যাওয়ার পর ভালো বন্ধু তৈরি করা বা পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার।
ভালো বন্ধু ও কাছের মানুশ পাওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ন সোর্স হচ্ছে ফ্যামিলি। কিন্তু ম্যাটেরিয়ালিজম এখানেও বাঁধা তৈরি করে রেখেছে। হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার (হীনমন্যতার মুখোশ), জাগতিক চাওয়া-পাওয়া ফ্যামিলির সদস্যদের কাছে আসতে দেয় না। এমনকি নিজের ভাই-বোনদের মাঝেও এটা দুরত্ব তৈরি করে দেয় (এটা কিভাবে ঘটে আমার জানা নাই। আমাদের ভাই-বোনদের ভেতরে যে বন্ডিং সেটা আমি বাইরের কোন ফ্যামিলিতে রেয়ারলি দেখতে পাই। এ বিষয়ে পরে আরো কথা হবে।)
পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট পলিটিক্স হচ্ছে ফ্যামিলি পলিটিক্স। সবচাইতে স্টুপিডও (স্টুপিড কেন সেটা নিয়ে পরে আরো কথা হবে)। এই ফ্যামিলি পলিটিক্সের মূলেও আছে বস্তুবাদ।
যার সাথে আপনার ইগো যত কম কাজ করবে তার সাথে বন্ধুত্ব তত গাঢ় হবে। একদম ইগোলেস ফ্রেন্ডশীপ যার সাথে, সে আপনার সোলমেট।
যাদের ভেতরে হিংসা আছে আপনি চাইলেও তাদেরকে আপন ভাবতে পারবেন না।
এই কথাটা আমি অনেকের কাছেই শুনেছি যে, সরকারী কর্মকর্তারা ঘুষ খেতে বাধ্য হয় অনেকটা বউ ও শশুরবাড়ির লোকজনের প্ররোচনায়। রেলমন্ত্রীর বউয়ের ফোনে যে টিটিইর চাকরি গেল, এটাও এধরনেরই একটা ঘটনা।
আবার এরকম পাবলিকও আমি চিনি; যারা টুকটাক দূর্নীতিও করতে পারে না বউয়ের কারণে।
লাইফ পার্টনার বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত হচ্ছে আপনার জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্তগুলোর একটা। কতকিছু যে মাথায় রাখতে হয়!
পার্টনারশীপ - ৪
প্যারেন্টিং বইটা লিখতে গিয়ে মূলত পার্টনারশীপ নিয়ে আলাদা একটা বই লেখা দরকার মনে হলো, সেখান থেকে এই পার্টনারশীপ সিরিজের শুরু। তো, প্যারেন্টিং এর সাথে পার্টনারশীপের সম্পর্কটা কতটা গভীর তার একটা উদাহরণ দেই-
মনে করেন আপনার বাচ্চাকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করা যে খারাপ, এটা শেখাতে চাচ্ছেন। কিন্তু, আপনার পার্টনারও এই কাজ করে। মানে, শব্দ করে দরজা বন্ধ করে। এখন আপনি যদি বাচ্চাকে শেখাতে যান, পার্টনার ভাববে ইনডাইরেক্টলি তাকে ইনসাল্ট করছেন। ফলে সম্পর্কে নেগেটিভ প্রভাব পড়বে। আবার যদি গোপনে বাচ্চাকে শেখান, সেটা অতটা কার্যকরী হবে না। কারণ, বাচ্চা দেখবে বাসায় অন্যরা শব্দ করে দরজা বন্ধ করছে।
তো, এক্ষেত্রে কী করবেন?
পুনশ্চঃ এটা একটা কালচারাল সমস্যা। পার্টনারের সাথে আলাপ করে আপনি তার এই অভ্যাস দূর করতে পারবেন না। কালচারাল/রুচিগত ও অভ্যাসগত সমস্যাগুলো আলাপ-আলোচনা করে সমাধান হয় না সাধারণত বরং পার্টনার অফেন্ডেড হয়। এই বিষয়টা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো।