প্যারেন্টিং

প্যারেন্টিং বিষয়ক চিন্তা-ভাবনা ও টিপস

#প্যারেন্টিং - ২০

তাতিয়ানা যখন আরো ছোট ছিলো, তখন খেলা শেষে নিজের খেলনাগুলো গুছিয়ে ঝুড়িতে রেখে দিতো। ইদানিং সে নিজের খেলনাগুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। কাল রাতে বললাম, চলো আমরা রুম পরিষ্কার করে ফেলি। এরপর সে নিজেই ঠিক করেছে যে খেলনাগুলো শুধু সে গোছাবে, আমাকে হাত দিতে দিবে না। দুজন মিলে সব সাজিয়ে, ঝাড়ু দিয়ে মুছে রুম ঝকঝকা করে ফেললাম। আজকে দেখলাম ব্যাগ থেকে খেলনা বের করে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখছে। রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখছে না।

আপনার বাচ্চাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে শেখান। ছোটবেলা থেকেই যদি সে অপরিচ্ছন্ন আর নোংরার মাঝে বড় হতে থাকে, তাহলে বড় হয়েও পরিচ্ছন্ন থাকতে পারবে না। এটা তার বাচ্চাদের ভেতরে এবং বন্ধুদের ভেতরেও সংক্রামিত হবে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটা মানুষ আরো নোংরা হতে শেখে। এটা আবার রোগের জীবানুর মত সে ছড়িয়ে বেড়ায়। অন্যদেরও অপরিচ্ছন্ন আর নোংরা করে ফেলে। এভাবে একটা গোটা জাতি অপরিচ্ছন্ন আর নোংরা হয়ে পড়ে।

#প্যারেন্টিং - ১৮

তাতিয়ানা হঠাৎ কোত্থেকে যেন সবকিছু নিজের বলে ঘোষণা করতে শিখে গেছে। যেগুলো তার নিজের সেগুলোকে সব 'আমার' বলতে শুরু করেছে। 'আমার বই', 'আমার খেলনা' ইত্যাদি ইত্যাদি। আগে সে সবকিছু শেয়ার করতো। নিজের জিনিষ অন্যেরা ধরতে পারবে না, এরকম কোন ধারণা ওর ছিলো না। কোথাও বেড়াতে গিয়ে এই ব্যপারটা তার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। ব্যপারটা নোটিশ করলেও কিছু বলিনি। সরাসরি বললে কাজের কাজ কিছু হবে না।

মাঝে মাঝে সে আমার ফোন নেয় খেলতে। ঐদিন রাতে এসে বলছে- 'বাবা, আমার ফোন দাও'। আমি বললাম, 'এটা তোমার ফোন?' সে একটু থমকে গেল। মিনিট খানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলো। কোন একটা জিনিষ নিজের না হলেও অন্যকে দেয়া যায় কিনা, নিজেরটা অন্যের সাথে শেয়ার করা যায় কিনা.... এসব ভাবছিলো হয়তো। আমি আবার বললাম- 'এটা কার ফোন বলো?' সে এবার হেসে বলে, "বাবার ফোন। আমার বাবার ফোন..."। ফোনের নেটওয়ার্ক অফ করে দিলাম ওর হাতে।

আমার খেলনা, আমার এটা/আমার ওটা... এগুলো বাচ্চাদের ভেতরে ঢুকে গেলে বিপদ আছে। স্বার্থপর হয়ে যাবে। বাচ্চাদের স্বার্থপর বানাবেন না। বাচ্চাদের স্বার্থপর বানানোর ফল সবার আগে আপনি নিজে ভোগ করবেন, তারপর বাকী জীবন সে নিজে ভোগ করবে। দীর্ঘমেয়াদে স্বার্থপররা কখনো জেতে না। খালি হারায়। তারা এটা বুঝতে পারে না।

#প্যারেন্টিং - ১৯

বাংলায় ভালো কিডস কনটেন্ট না থাকাতে তাতিয়ানাকে সব ইংরেজী রাইম আর কার্টুন নামিয়ে দিতে হয়েছে। এতে যেটা হয়েছে, বাংলা থেকে সে ইংরেজী বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলা বললে সে খুব একটা জবাব দেয় না, ইংরেজীতে বললে জবাব দেয়। এজন্য প্রথম কিছুদিন ওর সাথে ইংরেজীতেই কথা বলেছি। কিন্তু সম্প্রতি খেয়াল করলাম খেলনাদের সাথে সে ইংরেজীতে কথা বলছে। এরকম চললে কিছুদিন পর বাংলা ভুলে যাবে। সুতরাং ওর সাথে ইংরেজী আলাপ বন্ধ করে দিয়েছি।

ইংরেজী অবশ্যই জরুরী। কিন্তু ভাষা হিসেবে ইংরেজী অনেক সহজ। যেকোন বয়সে যেকেউ কিছুদিন চেষ্টা করলেই ইংরেজীতে ভালো লিখতে ও বলতে পারে। বাংলা অত সহজ না। সুতরাং আপনার বাচ্চাদের ইংরেজী শেখাবেন অবশ্যই কিন্তু বাংলা আগে শেখান। আপনার বাচ্চা যতগুলো ভাষা জানবে তার জন্য তত ভালো। বাংলা ভালো জানাটা বরং অনেক বড় যোগ্যতা, কারণ চাইলেই যেকেউ সহজে এই ভাষা শিখতে পারবে না।

#প্যারেন্টিং - ১১

মানুষের মন যদি একটা সফটওয়্যার হয় তাহলে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে কোডিং। আপনি ক্রমাগত কোড করে করে নিজেকে গড়ে তুলছেন। ভালো লাগা বা খারাপ লাগাটা মূলত হার্ডওয়্যার রেসপন্স। ব্রেইন আর নার্ভাস সিস্টেম মিলে ঐ হার্ডওয়্যার। ব্রেইন যাতে মজা পায় আপনার তাই করতে ভালো লাগে। ব্রেইনের এই মজা পাওয়াটা আবার আপনার ঐ মন নামক সফটওয়্যারের কোডের উপরে নির্ভর করছে। একারণে যে ছেলেটা স্কুলে একবার প্রথম হয় সে বারবার প্রথম হয়। কারণ, পড়তে বসলেই তার ভালো লাগে। নিজেকে সে ওভাবে কোড করে নিয়েছে। যে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করে, তার ব্যপারটাও সেরকম। সে নিজেকে ওভাবে কোড করেছে।

মন নামক এই সফটওয়্যারটার বেজ (যেটাকে কম্পিউটার সায়েন্সের ভাষায় কার্নেল বলে) তৈরি হয় ছোটবেলায়। বাবা-মা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও ছোটবেলার শিক্ষা এটা তৈরি করে। এজন্য একটা বাচ্চার ছোটবেলার প্রতিটা মূহুর্ত গুরুত্বপূর্ন। বড় হয়ে সে কেমন মানুষ হবে সেটা তার ঐ ছোটবেলার উপরে পুরোপুরি নির্ভর করছে। এটা মায়ের পেটে থাকতেই শুরু হয়।

তাই, "বাচ্চা মানুষ" ভেবে খারাপ কোনকিছুতে বাচ্চাদের প্রশ্রয় দেয়া উচিত না। বাচ্চারা কিছু বোঝে না মনে করা ভুল। প্যারেন্টদের এই ভুলের কারণে অনেকে মানুষ হতে পারে না।

#প্যারেন্টিং - ১২

বাচ্চারা ভুল করলে না বকে বড়দের মত করেই বোঝান, বুঝবে। বকা দিলে বা মারলে উলটো হতে পারে।

#প্যারেন্টিং - ১৩

'বাচ্চা মানুষ, বুঝবে না' ভাবা ভুল। বাচ্চাদের বোঝার ক্ষমতা ভালো। ওদের ব্রেইন সব গ্রহণ করে, মন খোলা থাকে।

#প্যারেন্টিং - ১৪

যেহেতু বাচ্চাদের ব্রেইন সব গ্রহণ করে ও মন খোলা থাকে, সেহেতু ওরা কি দেখছে কি শুনছে নিয়ন্ত্রন করুন।

#প্যারেন্টিং - ১৫

তাতিনকে আমরা স্যরি বলা শিখিয়েছিলাম। তারপর সে ভুল কিছু করলে স্যরি বলতো। একদিন রাস্তায় একটু ভাঙা থাকায় রিকশা ঝাঁকুনি লাগলো, সে রিকশাকে স্যরি বললো। রাস্তা নাকি রিকশাকে ব্যথা দিয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে টেবিল, চেয়ার, তেলাপোকা, টিকটিকি, পিঁপড়া... সবাইকেই স্যরি বলা শুরু করলো। আজকে হঠাৎ সে কারণে অকারণেই আমাকে স্যরি বলতে শুরু করেছে।

এখন ওকে স্যরি কম বলা শেখাচ্ছি। কোথায় স্যরি বলতে হবে কোথায় হবে না, সেটা। বেশী বললে 'স্যরি' অর্থহীন হয়ে যায়।

#প্যারেন্টিং - ১৬

যেকোন সংস্কৃতিতে Conception of cleanliness একটা খুব গুরুত্বপূর্ন জায়গা। আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষ সংস্কৃতি বলতে শুধুমাত্র নাচ/গান-নাটক/সিনেমা বুঝে থাকে (সংস্কৃতি বা কালচার বোঝার জন্য একটা লিংক দিলাম কমেন্টে), ফলে এই পরিচ্ছন্নতার ব্যপারটা তারা আমলে নেন না। বাচ্চাদের শেখান না। একারণেই মানুষ রাস্তা-ঘাটে চিপসের প্যাকেট ফেলতে দ্বিধা করে না। একারণেই দেখবেন বেশীরভাগ এলাকার রাস্তাঘাট, ঘর, দোকান.. সব কত নোংরা। একারণেই এদেশের পাবলিক টয়লেটগুলোতে আপনি কখনো ঢুকতে পারবেন না।

তাতিয়ানাকে আজকে কিছু পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান দিলাম। শুরু করেছি ঘর থেকে। প্রথমেই ঘুম থেকে ওঠার পর দাঁত ব্রাশ, বেসিনের ব্যবহার ও ওয়াশরুম পরিস্কার রাখা যায় কিভাবে দেখালাম। অল্প কথায় পয়েন্ট আউট করি-

১) বেসিন ব্যবহারের সময় অবশ্যই পানি বাইরে ছিটকে আসতে পারবে না
বেসিনের পারপাসই হচ্ছে পানির সুন্দর ড্রেনেজ নিশ্চিত করা। বেসিন ব্যবহার করার সময় যদি পানি বাইরে ছিটকে পড়ে, তাহলে বেসিনের সঠিক ব্যবহার হলো না। বেসিন শান্তভাবে ব্যবহার করতে হবে। অপ্রয়োজনে ট্যাপ ছেড়ে রাখা যাবে না।

২) ওয়াশরুমের ফ্লোরে পানি ফেলা যাবে না
ওয়াশরুমে এমনিতেই জীবানু বেশী থাকে। ফ্লোরে পানি ফেলে স্যাঁতস্যাতে করে ফেললে সেখানে আরো বেশী জীবানু জন্মে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ব্যবহারের জন্যও অস্বস্তিকর। ওয়াশরুমের ফ্লোর সবসময় শুকনো রাখতে হবে। কখনো ভুলক্রমেও যদি পানি পড়ে যায়, মপ দিয়ে সেটা মুছে ফেলতে হবে। যাদের ওয়াশরুমে গোছল করার জন্য আলাদা করে জায়গা নেই তারা প্রতিবার গোছলের পর ফ্লোর মপ করতে পারেন।

৩) টয়লেট টিস্যুর ব্যবহার ও কমোড ফ্লাশ ব্যবহার করা
টয়লেট টিস্যুর সঠিক ও পরিমিত ব্যবহার গুরুত্বপূর্ন। এখানে পরিমিতিটা যেহেতু ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত, তাই পরিমানটা উল্লেখ করলাম না। কমোড ব্যবহারের পরে অবশ্যই ফ্ল্যাশ করতে হবে।

৪) ওয়াশরুমে বেশী সময় অবস্থান অস্বাস্থ্যকর
জায়গাটা জীবানু পরিবেষ্টিত। তাই ওখানে যত কম সময় অবস্থান করা যায় তত ভালো। টিনেজদের ওয়াশরুমে মোবাইল নিয়ে ঢোকার ব্যপারে গাইডলাইন প্রয়োজন। মোবাইল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলে সময় খেয়াল রাখা কঠিন। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ন সমসাময়িক ব্যপার।

#প্যারেন্টিং - ১৭

তাতিয়ানার বয়স এক বছর হওয়ার আগেই নানা ধরনের শ'খানেক রাইম ভিডিও ভিডিও নামিয়ে দিয়েছিলাম। রাইমগুলোর ভেতরে এবিসি, ওয়ানটুথ্রি শেখার ভিডিওগুলো ওর বেশী প্রিয়। এগুলো দেখে দেখে সে ৯ মাস বয়সেই এবিসি ওয়ান টু থ্রি শিখে ফেলেছিলো। আমার বাসার বুকসেলফগুলো এবং আমাদের পড়ার অভ্যাস ওর এই আগ্রহ তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ, সে খুব মনোযোগ দিয়ে এবিসি শিখে প্রথমেই সেলফের সব ইংরেজী বইয়ের অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করে দিয়েছিলো। মূলত ঐ বইয়ের লেখাগুলোর সাথে রাইমের এবিসির মিল দেখতে পেয়েই ওর আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
বাংলা বইগুলো ওর কাছে দুর্বোধ্য ছিলো। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম বাংলাও সে পড়তে শুরু করেছে। তখন বয়স এক থেকে দেড় এর মত। আমি আর ফারাহ অবাক! ক্যামনে কী? পরে আবিষ্কার করলাম- ৭/৮ বছর আগে আইফোনের জন্য বাংলা বর্ণমালা শেখার যে এপটা বানিয়েছিলাম সেটা সে আমার মোবাইল ঘেঁটে বের করে ওখান থেকে অ আ ক খ শিখছে। অ আ ক খ শিখে প্রথমেই সে আমার সেলফের নাগালের ভেতরে থাকা বাংলা বইগুলো নামিয়ে বইয়ের ভেতরের বাংলা অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করেছিলো। এরপর অনেক খুঁজে ভালো কিছু বাংলা কনটেন্ট নামিয়ে দেই। দুই/আড়াই বছর বয়সে ও যখন বলতো, বাবা স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণ দাও, আমার কাছে বেশ মজা লাগতো। ব্যাঞ্জনবর্ণ শব্দটা আমার নিজেরই উচ্চরণ করতে কষ্ট হয় আর সে কি সুন্দর করে বলে।

তাতিয়ানার বয়স এখন চার। এখনো স্কুলে দেইনি। পড়তে বসার জন্যও বলি না। কিন্তু সে নিজেই খাতা-কলম-বই নিয়ে পড়তে বসে যায়। পড়ালেখা ওর কাছে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ব্যপার।

যাহোক, যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, বাসায় ছোট একটা লাইব্রেরী বানান। বাচ্চাদের হাতের নাগালে রাখুন বইগুলো এবং বাচ্চাদের সামনে পড়ুন, ওদের পড়ে শোনান (বাচ্চাদের বইগুলো)। আপনার বাচ্চাদেরও পড়ালেখার আগ্রহ তৈরি হবে, নিজে থেকে। তবে জোর করবেন না। যেটায় জোর করা হয় সেটার ব্যপারে মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহন থাকে না।

Trivuz Alam

Trivuz Alam

কাজ করি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে, বাদবাকী সব ভালো লাগা থেকে করা। নতুন কিছু শিখতে ভালো লাগে। গেমিং, বই পড়া, ফটোগ্রাফি, ভ্রমণ করা হয় ভালো লাগার জায়গা থেকে। আর ভালো লাগে চিন্তা করতে। সেসব চিন্তার কিছু কিছু প্রকাশ করবো এখানে।

সাম্প্রতিক লেখা

যেসব টপিক নিয়ে লেখালেখি করছি