বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ
বাংলাদেশে প্রতি ১৩ লাখ ৫৫ হাজার লোকের জন্য একটা ভার্সিটি আর আফগানিস্থানে চার লক্ষ তেতাল্লিশ হাজারের জন্য একটা। বাংলাদেশে ৫৫০ দিনের বেশী সময় ধরে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আর আফগানিস্থানে এই যুদ্ধাবস্থায়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অধঃপতন কোন অবস্থায় আছে সেটা বড় বড় কোম্পানীগুলোতে বিদেশীদের (বিশেষ করে ভারতীয়দের) নিয়োগ দেখলেই বুঝতে পারবেন।
এরকম একটা অবস্থায় বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়া কথা না বলে আফগানিস্থান নিয়া কথা বলাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১৯ মাসে ৩ হাজার ৩১৩ জন ব্যাংকার চাকরি ছেড়েছেন। দু’টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে থেকে চাকরি ছেড়েছেন ২ হাজার ৩০৯ জন। বাকি ১ হাজার ৪ জন চাকরি ছেড়েছেন অন্য চারটি ব্যাংক থেকে।
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৯ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ মাস ৯দিনে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে এসব কর্মী চাকরি ছেড়েছেন।
তথ্যসূত্রঃ ইনকিলাব, বাংলানিউজ২৪ ও বাংলা.রিপোর্ট
উত্তরার অধিকাংশ এক্সপেন্সিভ ফ্ল্যাটগুলো খালি হয়ে গিয়েছে কারণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পোস্টে জব করা লোকজন ওগুলোতে থাকতো। অন্য এলাকার কী অবস্থা জানি না। এমনিতে বিভিন্ন সূত্রে জব হারানোর যেসব পরিসংখ্যান জানি, সেগুলোও ভয়াবহ! বিশেষ করে উচ্চ বেতনের লোকজনের জব বেশী গিয়েছে শুনেছি, দেখছি।
ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের অধিকাংশেরই খুব খারাপ অবস্থা। কতগুলো পরিচিত বড় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হতে দেখলাম। আরো বিভিন্ন সেক্টরে নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছে গত দেড় বছরে। এগুলোর সাথে জড়িত বহু লোক জব হারিয়েছে।
পর্যটন সেবা ও বেসরকারী স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের অবস্থা তো আরো খারাপ। সংবাদপত্রগুলো সব বন্ধের পথে আছে। হাজার হাজার মিডিয়াকর্মীদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত।
এরকম একটা খারাপ সময়েও যদি পাবলিক রেস্পন্সিবল না হয়ে ফেসবুকে আজাইরা বিষয় নিয়ে মেতে থাকে, তখন তাদের দুর্দশা কে ঠেকাবে?
বিরুপ পরিবেশে গ্রোথ বেশী হওয়ার কথা। কারণ, ঐ পরিবেশ থেকে বের হওয়ার জন্য মানুশ আপ্রাণ লড়ার, লেগে থাকার প্রেরণা পেতে পারে।
মানুশ সম্পর্কে যাদের ধারণা যত বেশী নেগেটিভ, তাদের তত বেশী প্রতারিত হওয়ার চান্স থাকে। কারণ, বাস্তবে কোন মানুশই অতটা খারাপ নয় যতটা তারা ভাবে। ফলে, যখন কোন মানুশের সাথে গভীরভাবে মিশতে যায় তখন তারা সহজেই অবাক হয়ে ভাবতে থাকে- 'আরেহ, এতো পুরাই অন্যরকম, ভালো!' অল্প কয়েকটা প্যারামিটার এদেরকে বিভ্রান্ত করে দিতে পারে।
ইউটিউবের আইডিয়া আসে জাওয়েদ করিম নামের এক বাংলাদেশীর মাথায়। তারপর তিনি আরো দুইজনকে সাথে নিয়ে ইউটিউব প্রতিষ্ঠা করেন। খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সালমান খানও বাংলাদেশী। একাডেমিক ক্ষেত্রেও অনেক বড় বড় ফিগার পাবেন বাংলাদেশী। এদের সবার ভেতরে একটা কমন ব্যাপার হচ্ছে, এরা কেউই বাংলাদেশে বড় হয়নি, বাংলাদেশে পড়াশোনা করেনি।
জাতি হিসেবে বাংলাদেশীরা মেধাবী। এটা শুধুমাত্র আমার পর্যবেক্ষন না, অনেক বড় বড় মানুশের পর্যবেক্ষনও। কিন্তু এই মেধাবীরা এদেশে থাকলে কিছু করতে পারে না।
কেন?
আমি এর তিনটা কারণ খুঁজে পেয়েছি।
১) ব্যাড প্যারেন্টিং
২) ব্যাড এডুকেশন সিস্টেম
৩) ব্যাড এনভায়রমেন্ট / বাজে পরিবেশ
ব্যাড প্যারেন্টিং ও ব্যাড এডুকেশন সিস্টেম নিয়ে তো আগে অনেকবার বলেছি। আজকে এই বাজে পরিবেশটা নিয়ে কয়েকটা পয়েন্ট বলি-
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে (বিশেষ করে ফেসবুক) ট্রেডিশনাল মিডিয়াগুলোর ব্যবসা কমে গেছে। একটা পেপার বা টিভি চ্যানেলে দশ লাখ খরচ করে যেটুকু আউটপুট পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়াতে এক লাখ করলে তারচাইতে অনেক বেশী পাওয়া যায়। ফলে, প্রাচীন এই মিডিয়াগুলো এমনিতেই বন্ধের পথে। যেটুকু টিকে থাকার সম্ভবনা তাদের ছিলো সেটাও তারা হারিয়ে ফেলছে পাবলিকের আস্থা নষ্ট করে।
আমার খারাপ লাগছে হাজার হাজার মিডিয়া কর্মীদের জন্য। তাদের কী হবে?
পরিচিত বেশ কিছু ফ্যামিলি স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে। একজনের সাথে কথা হলো একটু আগে, তার পরিচিত ফ্যামিলিরাও দেশ ছাড়ার প্রসেসিং-এ আছে। এরা সব পয়সাওয়ালা ফ্যামিলি যাদের পক্ষে ইউরোপ/আমেরিকায় ৫/৬ কোটি ইনভেস্ট করে ওখানে ফুল ফ্যামিলি থাকার ব্যবস্থা করার ক্ষমতা আছে। কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক মন্দা এড়াতে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো পয়সাওয়ালা ও ইনভেস্টরদের নানা ধরনের প্যাকেজ দিচ্ছে তাদের দেশে মাইগ্রেট করার জন্য। এসবের সুবিধা নিচ্ছে অনেকে। আগামী কয়েক বছর এসব সুবিধা নেয়া লোকের সংখ্যা জ্যামেতিক হারে বাড়তে পারে।
ঐদিকে মেধাবীদের দেশ ছাড়ার হার আগের থেকে বাড়ছে। উদ্যোক্তারাও এদেশে ভরসা পাচ্ছে না। এপেক্সের মালিক দেখলাম কয়েকদিন আগে বলছেন ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা। অব্যবস্থাপনা কমানো না গেলে এবং সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নতুন বিনিয়োগও কমে আসবে।
তো কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক বিপর্যও ও এইসবের ইমপ্যাক্ট নিয়া ভাবতেছিলাম। পরিস্থিতি সবদিক থেকেই জটিলতর হচ্ছে।
অসমাপ্ত ভাবনা - ১
হিউমেন সাইকোলজি এমনিতেই আমার প্রিয় সাবজেক্ট। প্যারেন্টিং নিয়ে স্টাডি করতে গিয়ে এই বিষয়ে সিরিয়াসলি পড়া শুরু করেছিলাম। মূলত তাতিনের জন্য। ৬/৭ বছর ধরে এসব নিয়ে স্টাডি করে কিছুটা হলেও আমাদের মূল সমস্যাগুলো বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি কেন বাংলাদেশের মানুশের ব্রেইন এত ভালো হওয়ার পরেও আমরা ভালো করতে পারছি না। এর সমাধানগুলো নিয়েও ভেবেছি অনেক। এখন পর্যন্ত আলাদা একটা সমাজ গঠনের চাইতে বেটার সমাধান পাইনি।
আলাদা সমাজ মানে আপনি এমন কিছু মানুশজনদের নিয়ে একটা কমিউনিটি গড়ে তুলবেন যারা এই সমস্যাগুলোর বিষয়ে সচেতন। যারা প্যারেন্টিং জানে। যারা তাদের বাচ্চাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠার প্রয়োজনীয় পরিবেশ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু, এধরনের পাবলিকদের আপনি খুঁজে পেলেও তারা সকলে তো আপনার প্রতিবেশী না। দেয়াল ঘেরা একটা ছোট শহর বা জনপদ তো আর তৈরি করতে পারবেন না একসাথে থাকার জন্য। যে স্কুলে আপনার বাচ্চা যাবে সেখানে তো অসচেতন ফ্যামিলিগুলোর সন্তানেরাও আসবে। আপনার বাচ্চাকে প্রটেক্ট করতে পারবেন না ওখানে।
তাহলে?
ইউনেস্কোর এই ম্যাপটা দেখলে বুঝতে পারবেন। চায়না, রাশিয়া, জাপান, ইন্ডিয়া, ইভেন ইতালিতে স্কুল-কলেজ সব খোলা, কিছু জায়গায় পার্শিয়ালি খোলা। কিন্তু খুব কম দেশই আছে যেইখানে পুরাপুরি বন্ধ।
এক বছরের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। এতে কী হচ্ছে? এতে দু'টো শিক্ষাবর্ষে পড়ালেখা হয়নি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় গ্যাপ পড়ে গিয়েছে। এরকম গ্যাপ পড়লে আবার পড়ালেখায় ব্যাক করা কতটা কষ্টকর সেটা অনেকেই জানেন আশা করি। এই শিক্ষার্থীদের আর পড়ালেখা হবে?
এর সাথে যোগ হয়েছে অটো-পাশ। যারা বর্তমান ক্লাশের পড়া না পড়েই নতুন ক্লাশে উঠে গেল, তারা আর বুঝতে পারবে না কিছু। ফলে, তাদের বাকী শিক্ষা জীবন হুমকির মুখে পড়ে গেল।
১২-টা ব্যাচের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের জীবন ধ্বংস হওয়ার পথে আছে। এর কুফল আপনি টের পাবেন ১৫-২০ বছর পরে। এমনি এদেশে যোগ্য লোকের খুব অভাব। এই ঘটনার পর আর লোক পাওয়াই যাবে না। ২০ বছর পর দেখবেন দেশের অধিকাংশ জব করতেছে ভারতীয়রা। আর বাংলাদেশীরা সব তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী, পিওন হয়ে বসে আছে। যে অল্প কিছু মানুশ পারিবারিক সচেতনতার কারণে পড়ালেখা করেছে, এরা সব দেশ ছাড়বে তখন। পরিস্থিতিটা কেমন হবে, কল্পনা করে দেখেন।
এই মূহুর্তে এটা দেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত, কিন্তু কোথাও কোন আলাপ নাই।
The Post Corona Era
২০২০ এর মাঝামাঝি কিংবা ২০২১ সাল থেকে আমরা এই নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের কারণে গত বিশ বছর ধরে পৃথিবী অনেক দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিলো। পোস্ট করোনা এরা যুক্ত করেছে নতুন আরেকটা ডাইমেনশন। অতীতের হিসাব-নিকাশ এমনিতেই অচল হয়ে পড়েছিলো এখন পুরোপুরি বদলে যাবে।
করোনা পরবর্তী যুগের হিসাব নিকাশ যারা বুঝবে না তারা ক্যারিয়ার, ব্যবসা-বানিজ্য, রাজনীতি; কোনটাতেই ভালো করতে পারবে না।