সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান

বেঁচে থাকার জন্য খাবার খেতে হয়। আর ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য লাগে সুষম খাবার (Balanced Diet)। আমরা প্রতিদিন অনেক খাবারই খাই, কিন্তু সেগুলোর ভেতরে কোনটি শরীরের জন্য কতটুকু প্রয়োজন এটা কি আমরা জানি? কোন গুরুত্বপূর্ন উপাদান আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি কিনা, তা জানাও জরুরী। এসংক্রান্ত বিষয়াদী নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

সুষম খাবার কী?

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরকে প্রতিদিন শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি গ্রহণ করতে হয়। আর এগুলো সব পরিমিত পরিমানে যেসব খাবারে আছে, সেগুলোই  হলো সুষম খাবার। সুষম খাবার বা ব্যালেন্সড ডায়েট আরো পরিষ্কার ধারনার নিতে চাইলে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। এই উপাদানগুলোকে দু'টো প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১) ম্যাক্রোনিউট্রেন্ট (Macronutrients) ও ২) ভিটামিন ও মিনারেলস (Vitamins and Minerals)

ক) ম্যাক্রোনিউট্রেন্ট (Macronutrients)

মানবদেহের জন্য বিভিন্নরকম উপাদান প্রয়োজন। যে উপাদানগুলো বেশী পরিমানে লাগে, সেগুলোকে ম্যাক্রোনিউট্রেন্ট শ্রেণীতে ফেলা হয়েছে। এই শ্রেণীতে আছে তিনটি উপাদান। আমিষ (Proteins), শর্করা (Carbohydrates) এবং লিপিড বা ফ্যাট (Lipids / Fat)। এগুলো শরীরে শক্তি যোগায়। এই শক্তির একক হচ্ছে ক্যালরি (Calorie)। কোন উপাদানে কতটুকু ক্যালরি রয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত হিসাব দেয়া হলো

  • প্রতি এক গ্রাম শর্করাতে রয়েছে চার ক্যালরি
  • প্রতি এক গ্রাম চার ক্যালরি এবং
  • প্রতি এক গ্রাম লিপিড বা চর্বিতে রয়েছে নয় ক্যালরি

আপনার শরীরে প্রতিদিন যত ক্যালরি শক্তি প্রয়োজন তত পরিমান আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। এর কম করলে আপনি শুকিয়ে যাবেন, বেশী করলে মোটা হয়ে যাবেন। দু'টো অবস্থাই আপনার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে আপনার স্বাস্থ্য খারাপ করে দেয়। এই ক্যালরির চাহিদা আবার বয়স ও লিঙ্গভেদে পরিবর্তন হয়। নিচে দেয়া ক্যালরি চার্ট থেকে আপনার জন্য ক্যালরির চাহিদা জেনে নিতে পারেন। এই চার্টটি বা পুরো লেখাটি প্রিন্ট করে আপনার কিচেনের দেয়ালে সেঁটে দিতে পারেন। আমিষ, শর্করা এবং চর্বি জাতীয় উপাদান পেতে কেমন ধরনের খাবার খেতে হবে, সেসব নিয়ে আমরা নিচে আলোচনা করবো।

বয়স ও লিঙ্গভেদে ক্যালরির চাহিদার তালিকা

খ) ভিটামিন ও মিনারেলস (Vitamins and Minerals)

মানবদেহের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও মিনারেলস বা খনিজ উপাদান প্রয়োজন হয়। প্রতিটা ভিটামিন ও খনিজ উপাদানই গুরুত্বপূর্ন শরীরের জন্য। এগুলো আবার একে অপরের পরিপুরক। এই যেমন ভিটামিন ডি (Vitamin D) শরীরকে খনিজ উপাদান ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে সাহায্য করে যা মজবুত হাড়ের গঠনের জন্য প্রয়োজন। ক্যালসিয়ামের অভাবে আপনার হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু শুধু ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলেন কিন্তু ভিটামিন ডি এর অভাবে শরীর সেটাকে নিতে পারলো না, তাহলে তো হলো না। আবার খনিজ উপাদান আয়রন প্রয়োজন আপনার রক্তের হিমোগ্লোবিনের জন্য প্রয়োজন। এরকম আরো অনেক উপাদান রয়েছে। যেমন- ফলেট, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম, জিংক এবং ভিটামিন A, D, E, K এবং B complex.


১) শর্করা (Carbohydrates)

মানবদেহে শর্করা জাতীয় খাবার সবচাইতে বেশী পরিমানে লাগে। আমেরিকান কৃষি গবেষণা সংস্থা USDA প্রতিদিনের ক্যালরির ৪৫ থেকে ৬৫ ভাগ পর্যন্ত শর্করা জাতীয় খাবার থেকে সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, এজাতীয় খাবারগুলো শরীর সহজে গ্রহণ করতে পারে। মানুষের ব্রেইন, কিডিনি এবং পেশীগুলো ঠিকঠাকমত কাজ করতে শর্করার প্রয়োজন হয়। এমনকি চর্বি জাতীয় খাবার থেকে শরীর ঠিকমত শক্তি গ্রহণ করতে পারে যদি পরিমানমত শর্করাজাতীয় খাবার সাথে থাকে।

শর্করার একটি বড় উৎস হচ্ছে দানাদার ও শক্ত খাবারগুলোতে, যেমন- শস্যকনা (ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি), আলু, ফলমূল এমনকি দুধ ও দধিতেও। শাকসব্জি, সীম, বাদাম ও চীজেও শর্করা থাকে, তবে অল্প পরিমানে।

আঁশ (Fiber) জাতীয় খাবার গুরুত্বপূর্ন। ফাইবার শরীর হজম করতে পারে না কিন্তু শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজনে এটি লাগে। জন্য এটি প্রয়োজন। ফাইবার রেচনতন্ত্রকে ভালো রাখে, কোলস্টোরেল ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনে। ফলমূল, শবজি ও শস্যদানা জাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকে।

২) আমিষ (Proteins)

USDA-এর পরামর্শ অনুযায়ী ১০-৩৫ ভাগ ক্যালরি আপনাকে আমিষ জাতীয় খাবার থেকে নিতে হবে। মানুষের শরীরের কোষগুলোর প্রায় বেশীরভাগই এই উপাদানের তৈরি। আপনার পেশী গঠনে এটি সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ন। প্রতিদিন আমাদের শরীরে অসংখ্য কোষ মারা যায়, সেগুলোর ঘাততি পুরনের জন্যও আমিষ জরুরী। হজম ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য ব্যবহৃত এনজাইমগুলো তৈরি হতে এই আমিষ উপাদানে লাগে। শরীর প্রোটিনকে ভেঙে বিভিন্ন এ্যামিনো এসিড তৈরি করে। এরকম প্রায় ৫০০ ধরনের এ্যামিনো এসিডের সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলো শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ন।

আমিষ জাতীয় খাবারের বড় উৎস হচ্ছে মাছ, মাংস, বাদাম, কিছু কিছু শস্যদানা। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল উদ্ভিদজাত প্রোটিন গ্রহনের ব্যপারে পরামর্শ দিয়েছে। ফলমুল, সবজি, বিভিন্ন ধরনের ডাল জাতীয় শস্য ও সয়া বীজ। পোলট্রি (হাঁস/মুরগী) থেকে পাওয়া আমিষও নিরাপদ বলে তারা জানিয়েছে।

২) লিপিড বা চর্বি (Lipid / Fat)

শর্করা ও আমিশের মত চর্বিও মানবদেহের শক্তি যোগায়। পরিমানমত চর্বি মানব দেহের জন্য জরুরী। চর্বি জাতীয় খাবারে স্যাচুরেটেড ও আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকে। স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড আপনার শরীরে খারাপ কোলস্টেরল বাড়িয়ে দিবে যা ক্ষতিকর। মূলত ভেজিটেবল তেল ও পশুর মাংস থেকে যে চর্বি পাওয়া যায়, তাতে এধরনের খারাপ কোলস্টেরল বেশী থাকে। ট্রান্স ফ্যাট (trans fat) যুক্ত খাবার মানবদেহের জন্য অনেক ক্ষতিকর। ট্রান্স ফ্যাট দু'টো উৎস থেকে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিকভাবে ও মানুষের তৈরি। পশুর শরীরের তেল এবং মানুষের তৈরি বিভিন্ন কৃত্তিম খাবারে ব্যবহৃত কৃত্তিম তৈল ও ভাজাপোড়া খাবার এর অন্যতম উৎস। তাই চর্বি গ্রহনের বেলায় সাবধান। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা তাই নিরাপদ চর্বির উৎস হিসেবে মাছের তেল, অলিভ ওয়েল (জলপাইয়ের তেল), বাদাম জাতীয় খাবার বেছে নিতে বলে থাকেন।

৪) ভিটামিন ও খনিজ উপাদান (Vitamins and Minerals)

ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উপরে অল্প কথায় আলোচনা হয়েছে। ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান উৎস প্রাকৃতিকভাবেই মেলে। পশুর কলিজা, তৈল, ডিম, মিস্টি আলু, গাজর, পাতাযুক্ত শবজি, ছোট মাছ, সীম জাতীয় তরকারী, বাদাম, সয়া জাতীয় খাবার ও সকল ধরনের ফলমূলে আপনি প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল পাবেন। তবে খনিজ উপাদানের ভেতরে লবন কম খাওয়ার চেষ্টা করবেন। এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

৫) পরিমানমত পানি

খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখুন, 'পরিমানমত' বলা হয়েছে। প্রচুর বলা হয়নি। পানি শরীরের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ন। যদি প্রয়োজনমত না খান, তাহলে যেমন শরীরের ক্ষতি হবে তেমনি অতিরিক্ত খেলেও শরীরের ক্ষতি হবে। আপনার ওজনের প্রতি কেজির জন্য চল্লিশ মিলি লিটার পানি প্রয়োজন। আপনার ওজন যদি হয় ৭০ কেজি, তাহলে পানি লাগছে ২৮০০ মি.লি বা প্রায় তিন লিটারের মত। এখন আপনি যদি এক লিটারও না খান বা পাঁচ লিটার খেয়ে ফেলেন, উভয়ই ক্ষতিকর। সুতরাং পরিমানমত পানি পান করুন।

উপরে আলোচিত প্রতিটি খাদ্য উপাদান ও আপনার জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি নিয়মিত সংগ্রহ করাই হচ্ছে সুষম খাবার গ্রহণ করা। আপনার রুচি ও আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে নিজের জন্য সুষম খাবারের তালিকা বানিয়ে নিন। এসম্পর্কে ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে জানিয়ে আজকের মত এখানেই শেষ করছি। নিচে একটি চার্ট দেয়া হলো, এটিও সংগ্রহে রাখতে পারেন। ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।


ত্রিভুজ আলম

ত্রিভুজ আলম

কাজ করি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে, বাদবাকী সব ভালো লাগা থেকে করা। নতুন কিছু শিখতে ভালো লাগে। গেমিং, বই পড়া, ফটোগ্রাফি, ভ্রমণ করা হয় ভালো লাগার জায়গা থেকে। আর ভালো লাগে চিন্তা করতে। সেসব চিন্তার কিছু কিছু প্রকাশ করবো এখানে।

সাম্প্রতিক লেখালেখি

লেখকের আরো লেখা

ত্রিভুজ আলম কমিউনিকেশন স্কিল - ১

কিছু মানুষকে দেখবেন আপনার খুব ভালো লাগে আর কিছু মানুষকে বিরক্তিকর। কিছু মানুষ সহজেই আপনাকে সব বুঝিয়ে দিতে পারে আর কিছু মানুষ সারাদিন কথা বলেও বোঝাতে প...

ত্রিভুজ আলম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল - একটি সফল বানিজ্যিক রহস্য!

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই রহস্য প্রিয়। রহস্য প্রিয় মানুষেরা রহস্যের খোঁজে বের হয়ে যুগে যুগে পৃথিবীর জন্য অনেক কিছু করেছেন তাই রহস্যপ্রিয়তাকে মানুষের স্বভাব...

ত্রিভুজ আলম ভাইরাসমুক্ত নিরাপদ কম্পিউটার

উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের ভেতরে এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি কখনো ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। এন্টিভাইরাস সফটওয়্যারের পেছনে অনেক টাক...