উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারকারীদের ভেতরে এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি কখনো ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। এন্টিভাইরাস সফটওয়্যারের পেছনে অনেক টাকা ঢেলেও ভাইরাসের যন্ত্রনা থেকে পুরোপুরি বাঁচা সম্ভব হয় না। ব্যপারটা কতটা বিরক্তিকর, ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। কেমন হতো যদি আপনার কম্পিউটারে কখনো ভাইরাস না ধরতো? ভাইরাসের যন্ত্রনা থেকে বাঁচার কিছু উপায় বলে দেব আজকে।
ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার আগে আপনাকে জানতে হবে কিভাবে একটি কম্পিউটারে ভাইরাস আক্রান্ত হয়। মূলত চারটি উপায়ে কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ক) সফটওয়্যার/গেমস ইনষ্টল করতে গিয়ে
খ) ফাইল শেয়ার করতে গিয়ে
গ) ইচ্ছাকৃত/উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে কেউ ভাইরাস ইনফেক্টেড করে দিলে
ঘ) ইন্টারনেট/ওয়েব থেকে
সুতরাং এই চারটি বিষয়ে যদি আপনি সতর্ক থাকতে পারেন, তাহলে আপনি ভাইরাস মুক্ত থাকতে পারবেন। কিন্তু কিভাবে সতর্ক থাকবেন?
কম্পিউটার চালানোর জন্য অপারেটিং সিস্টেম সেটাপ করার পরপরই আপনার লাগে বিভিন্ন ধরনের এপ্লিকেশন সফটওয়্যার ও টুলস। এগুলো তৈরি করে থাকে বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানী। একটি কোম্পানী সফটওয়্যার তৈরি করে মূলত বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে। তারা কেন খামোখা আপনাকে ভাইরাস আক্রান্ত করতে যাবে যেটা তাদের ব্যবসার সুনাম ক্ষুন্ন করবে? মূলত, বড় কোন কোম্পানী কখনো নিজেদের সফটওয়্যারের ভেতরে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যবসার সুনাম ক্ষুন্ন করতে চাইবে না। তবুও একটি নামকরা বড় কোম্পানীর সফটওয়্যার থেকে কয়েকভাবে আপনার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকতে পারে। তাই নিচের সতর্কতাগুলো অবলম্বন করুন।
১) সবসময় অরজিনাল সোর্স থেকে সফটওয়্যার সংগ্রহ করুন
মনে করুন আপনি মাইক্রোসফট অফিসের লাইসেন্স কিনেছেন। এখন সফটওয়্যারটা সরাসরি মাইক্রোসফটের ডিস্ট্রিবিউটর বা তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে নামানোর কথা। তা না করে যদি আপনি অচেনা কোন প্রতিষ্ঠান যারা মাইক্রোসফটের ডিস্ট্রিবিউটর বা বিক্রয় প্রতিনিধি নয়, তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন অথবা মাইক্রোসফটের অফিশিয়াল ওয়েব থেকে না নামিয়ে অন্য কোন ওয়েবসাইট থেকে নামান, তাহলে সেটার সাথে ভাইরাস আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুতরাং সবসময় যে প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার কিনবেন তাদের সোর্স থেকেই সংগ্রহ করবেন। কোন সফটওয়্যারের অফিসিয়াল সাইট কোনটা, একটু সার্চ করলেই বের করা যায়। উইকিপিডিয়াতেও পাবেন।
২) পাইরেটেড সফটওয়্যার এড়িয়ে চলুন
অধিকাংশ কম্পিউটার ভাইরাস/ট্রোজান আক্রান্ত হয় পাইরেটেড ভার্সন ব্যবহার করতে গিয়ে। আপনি হয়তো মাইক্রোসফটের ওয়েবসাইট থেকেই অফিস প্রোগ্রামটা নামিয়েছেন কিন্তু সেটার সিরিয়াল ক্রাকার বা কীজেনারেটর নামিয়েছেন কোন টরেন্ট বা পাইরেসী মাধ্যম থেকে। সেই ক্রাক/কিজেনারেটর প্রোগ্রামের ভেতর থেকেই আপনাকে ভাইরাস ধরার সম্ভবন খুব বেশী। হ্যাকার/ক্রাকাররা এসব প্রোগ্রাম বিলি করেই এই ভাইরাস/ট্রোজান ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। এটা থেকে তারা নানাভাবে অর্থ কামাইয়ের উপায় বের করে নেয়। সুতরাং সাবধান থাকুন। পাইরেটেড সফটওয়্যারগুলো এড়িয়ে যান, ভাইরাস মুক্ত থাকুন। যেসব সফটওয়্যার কেনার পর্যাপ্ত অর্থ আপনাদের কাছে নেই, সেগুলোর বিকল্প ফ্রি/ওপেন সোর্স সংস্করণ খুঁজে নিন। তবে অবশ্যই নামকরা বিকল্পগুলো নিবেন এবং তাদের অফিসিয়াল সাইট/সোর্স থেকে নামাবেন।
৩) আপনার ভাইরাস মুক্ত সফটওয়্যারগুলো অন্য কোন ভাইরাস আক্রান্ত সিস্টেমের সংস্পর্শে আসতে দিবেন না
আপনার কেনা বা সংগ্রহ করা সফটওয়্যারগুলো হয়তো পেন ড্রাইভ বা হার্ডডিস্কে রেখেছেন। সেই ড্রাইভ যদি কোন ভাইরাস আক্রান্ত সিস্টেমে প্রবেশ করান, তাহলে আপনার ভালো সফটওয়্যারগুলো ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। তাই আপনার এই ব্যাকাপ ড্রাইভগুলো অন্য কোন সিস্টেমে কানেক্ট করা থেকে বিরত থাকুন। অথবা, সফটওয়্যৌারগুলোকে জিপ করে এক্সটেনশন বদলে নিন। যেমন আপনি হয়তো একটি সফটওয়্যার কিনেছেন বা নামিয়েছেন যেটার নাম InspireApp. এখন ফাইলটিকে জিপ করার পর এর নাম হলো InspireApp.zip. শেষের এই .zip অংশটুকুর আগের ডট (.) টি তুলে দিন। ফাইলটির নাম হবে তখন InspireAppZip. পরে যখন ব্যবহার করতে চাইবেন, আবার ডট বসিয়ে InspireApp.Zip করে নিন। এছাড়াও অনলাইনে তুলে রাখতে পারেন।
৪) সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করুন
আপনার কেনা সফটওয়্যারগুলো প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে। যদি আপনার কম্পিউটারটি খুব বেশী পুরাতন না হয়ে থাকে তাহলে নিয়মিত আপডেট করুন। অপারেটিং সিস্টেমও আপ-টু-ডেট রাখুন। ভাইরাস এবং নানারকম সিকিউরিটি থ্রেট থেকে বাঁচার জন্য এটা জরুরী।
উপরের টিপসগুলো তো আমার পক্ষে পালন করা সম্ভব না, তাহলে?
আপনি হয়তো ভাবছেন, সকল সফটওয়্যার বা গেমস তো আমার পক্ষে কেনা বা অরিজিনাল সোর্স থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে কী করবো? সেক্ষেত্রে আপনার কম্পিউটারে দু'টো অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করুন। একটি আপনার কাজের জন্য, আরেকটি এন্টারটেইনমেন্ট/গবেষনার জন্য। খেয়াল করে দেখুন, আপনার কাজের জন্য খুব বেশী সফটওয়্যার প্রয়োজন নেই। যেগুলো খুব কমন ও বেশী প্রয়োজনীয়, তার প্রায় সবকয়টিরই ফ্রি/ওপেনসোর্স/ক্লাউড ভার্সন আছে। কাজের জন্য যে অপারেটিং সিস্টেমটি সেটাপ করবেন, সেখানে অপ্রয়োজনীয় কিছু রাখবেন না। অন্য আরেকটি অপারেটিং সিস্টেমে ইচ্ছেমত যা-খুশি-তা ইনস্টল করতে পারেন, টেস্ট করা/গবেষণা করা বা স্রেফ আনন্দের জন্য। সেখানে ভাইরাস ধরলে অপারেটিং সিস্টেম মুছে দিয়ে আবার সেটাপ করুন। কাজের সিস্টেম অক্ষত রইলো এতে।
কম্পিউটারগুলো সবচাইতে বেশী ভাইরাস আক্রান্ত হয় ফাইল শেয়ারিং করতে গিয়ে। ধরুন আপনার কম্পিউটারে কোন ভাইরাস নেই কিন্তু আপনার বন্ধুর কম্পিউটারে আছে। আপনি পোর্টেবল হার্ড ড্রাইভ বা পেন ড্রাইভ ঐ কম্পিউটারে লাগিয়ে একটা ফাইল কপি করে নিজের কম্পিউটারে সেই ড্রাইভ লাগানো মাত্র ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশী। আপনি হয়তো একটি সাধারণ মিউজিক ফাইল কপি করছিলেন যেটায় ভাইরাস থাকার কথা না। কিন্তু আপনার ড্রাইভটাই পুরোপুরি ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে যাওয়াতে আপনার সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকে যাবে। এক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে- বাইরের কোন হার্ড ড্রাইভ বা পেন ড্রাইভ আপনার কম্পিউটারে না লাগানো। আপনার নিজের ডাইভগুলোও অন্যদের কম্পিউটার লাগাবেন না।
তাহলে ফাইল ট্রান্সফার করবেন কিভাবে?
ক্লাউড বেসড ফাইল শেয়ারিং সার্ভিসগুলো ব্যবহার করুন। অন্যজনকে বলুন তার ফাইলগুলো অনলাইনে আপলোড করে আপনাকে ডাউনলোড লিংক দিয়ে দিতে অথবা ড্রপবক্স/গুগল ড্রাইভ/ওয়ান ড্রাইভ বা আপনার পছন্দের ক্লাউড সার্ভিসে একটি ফোল্ডার শেয়ার করে নিন। এভাবে ফাইল শেয়ারিং প্রক্রিয়া একটু স্লো হলেও অযথা ভাইরাসের ঝুঁকি থেকে বাঁচবেন। মনে রাখুন, একবার ভাইরাস ঢুকে গেলেও কিন্তু আপনার প্রচুর সময় নষ্ট হবে। ফাইল হারানো থেকে শুরু করে আরো অনেক ধরনের বিপদে পড়তে পারেন। সুতরাং ক্লাউড সার্ভিসগুলো (ফ্রি বা পেইড) ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে যান।
কেউ যদি এভাবে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেয়, তাহলে উপরের কোন সতর্কতাই আপনাকে বাঁচাতে পারবে না। এক্ষেত্রে সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে আপনার কম্পিউটারে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখা এবং সেটা অন্য কাউকে ব্যবহার করতে না দেয়া। এমনকি আপনার ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের পাঠানো সার্ভিসের লোকজনকেও না। যদি তারা নেট কনফিগার করতে আসেও, সামনে বসে থাকুন। খেয়াল করুন সে কোন পেন ড্রাইভ/হার্ড ড্রাইভ কানেক্ট করছে কিনা, অথবা তাদের এফটিপি থেকে কোন ফাইল নামাচ্ছে কিনা। ইন্টারনেট কনফিগার করার জন্য বাইরে থেকে কোন ফাইল তাদের নামানোর কথা না। একটু সাবধান থাকুন। কখনো সার্ভিসিং এ পাঠালে এমন কোথাও পাঠান যাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম ভালো। সবচাইতে ভালো হয় যদি আপনি নিজেই সার্ভিসিং করতে পারেন অথবা বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে করাতে পারেন। এটা আপনার নিরাপত্তার প্রশ্ন। আপনি যদি খুব গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে এসব ব্যপারে অনেক বেশী সতর্কতা অবলম্বন করুন।
ফাইল শেয়ারিং এর মতই ইন্টারনেট/ওয়েব থেকে অনেক বেশী ভাইরাস আসার সম্ভবনা থাকে। এ-থেকে বাঁচার জন্য নিচের উল্লেখ করা ব্যপারগুলো মাথায় রাখবেন-
১) অচেনা অজানা কারো দেয়া কোন লিংকে ক্লিক করবেন না
২) কোন লিংকে ক্লিক করার পর কিছু ইনস্টল করতে চাইলে অভিজ্ঞ কারো সাথে পরামর্শ ছাড়া ইনস্টল করবেন না
৩) অনেক সময় কোন একটি ওয়েব সাইট ভিজিট করার পর হয়তো সেখানে ম্যাসেজ আসলো যে- আপনার কম্পিউটারে ভাইরাস আছে, এটা করুন.. ওটা করুন। এগুলো নিজেই আসলে ভাইরাস/ট্রোজান/হ্যাকিং এটেম্প। চোখ বন্ধ করে ইগনোর করুন।
৪) অচেনা/অজানা সাইটে যতটা সম্ভব কম ভিজিট করুন।
৫) যেসব সাইটে প্রচুর বিজ্ঞাপণ দেখায়, এরকম সাইট যতটা সম্ভব বয়কট করুন (এগুলোর বেশীরভাগই আপনার কম্পিউটারে নানারকম ভাইরাস/ওয়র্ম/ম্যালওয়্যার ইনফেক্ট করার চেষ্টা করবে)। ব্রাউজারে এড ব্লকার টাইপ এক্সটেনশনগুলো (eg. AdBlock) ব্যবহার করবেন না। ওগুলো করলে এধরনের সাইটগুলো ধরতে পারবেন না।
৬) যেসব সাইট ওপেন করলেই পপআপ আসে এসব সাইটের ব্যপারে সতর্ক থাকুন। কোন সাইট থেকে খুব বেশী আসলে, ঐ সাইট পুরোপুরি বয়কট করুন।
৭) ইমেইল এটাচমেন্টের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। চেষ্টা করুন পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় ও রেপুটেড মেইল সার্ভিসগুলো ব্যবহার করতে।
৮) ফেসবুকে নানা ধরনের হাবিজাবি এপ্লিকেশন ইনস্টল থেকে বিরত থাকুন
৯) ইনবক্সে কেউ কোন লিংক দিলেই ক্লিক করবেন না। সেটা দেখতে আকর্ষনীয় কোন ভিডিও মনে হলেও। এমনকি আপনার পরিচিত বিশ্বস্ত কারো কাছ থেকে ম্যাসেজ আসলেও। এরকম ক্ষেত্রে আগে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিন, লিংকটা সে পাঠিয়েছে কিনা। কারণ, নানা ধরনের ভাইরাস নিজে থেকে এসব লিংক ছড়াতে পারে।
১০) কখনো কোন সাইটে ঢোকার সময় এড্রেসবারে খুব ভালো করে খেয়াল করবেন, যে সাইটে প্রবেশ করতে চাচ্ছেন সেটাই কিনা। দেখতে একইরকম হলেও অনেক সময় সাইটটা অন্যকিছু হতে পারে। এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে হ্যাকিং থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে লেখা পরবর্তী আর্টিকেলে।
এগুলো সব মেনে চলতে পারলে মোটামুটি ভাইরাসের যন্ত্রনা ছাড়াই বছরের পর বছর কম্পিউটার চালাতে পারবেন। তবুও, সতর্কতা হিসেবে সবসময় হার্ডডিস্কের ডাটা ব্যাকাপ রাখবেন। পোর্টেবল ড্রাইভ ও ক্লাউডে। হ্যাপি কম্পিউটিং...।